তখন মূলত হল আর মদিনা মার্কেট ঘিরে আমাদের আনাগোনা। ডি বিল্ডিং, সি বিল্ডিং ও সি বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন রুমে রিহার্সেল হতো। প্রক্টর অফিসে আগে থেকে রুমের জন্য আবেদন করে রাখতে হতো। গানবাজনা, নাটক তখন অনেকের চক্ষুশূল। প্রতিকূল পরিবেশ। যেকোনো সময়ে আয়োজন বন্ধ হয়ে যেতে পারে—এমন আশঙ্কা নিয়েই কাজ করতাম।

ক্লাস শেষে সাধারণত বিকেলে অথবা ছুটির দিনে সকালে নির্ধারিত সময়ে হাজির হতাম। স্ক্রিপ্টের ফটোকপি সবার পকেটে। চেয়ার-টেবিল সবাই মিলে এককোণে সরিয়ে রাখার পর রুমটা একেকদিন ঝাড়ু দিতাম একেকজন। তারপরে গোল হয়ে বসে পাণ্ডুলিপি পাঠ, হালকা কিছু কোরিওগ্রাফি, সমবেত সংগীত বা শুধুই গল্পগুজব। হাতে হাতে মোবাইল বোধহয় তখনো আসেনি, তাই মহড়ার মাঝখানে উৎপাত কম ছিল।

সোহেলভাই তখনো সবার সিনিয়র। ক্যাম্পাসের পাট চুকে গেলেও প্রায় নিয়মিত আমাদের ফ্লোরে আসতেন। মাঝে মাঝে দীপ্তিদিও আসতেন। তাঁরা সিলেটেই চাকরি করতেন, সম্ভবত এনজিওতে। তাঁরা এলে আমরা খুশি হতাম, কারণ সেদিন ফ্লোরে বাড়তি খাবার সরবরাহ নিশ্চিত। অথবা কোনোদিন আমরা দল বেঁধে হাঁটতে হাঁটতে ইউনিভার্সিটি গেট পর্যন্ত যেতাম, তারপর সেখানকার কোনো টং দোকানে বসে ভাজাভুজি সাবাড় করতাম। কেউ কেউ প্রয়োজনের অতিরিক্ত চেয়ে নিত, কারণ বিল পরিশোধের দায় গৌরী সেনের। তাছাড়া তখন আমাদের হজমশক্তিও ছিল সাংঘাতিক।

মাঝে মাঝে সোহেলভাইয়ের বাসায়ও গিয়ে হানা দিতাম। তিনি সবাইকে প্রশ্রয় দিতেন। কারণ, দিক থিয়েটার ছিল তাঁর প্রাণের সংগঠন। তিনি হবিগঞ্জি টানে প্রাণবন্ত বাংলায় সাবলীল বক্তব্য দিতেন এবং আমাদের সস্নেহ শাসন করতেন। প্রতিটি অনুষ্ঠানে, গুরুত্বপূর্ণ সভায়, আয়োজনে তাঁকে পাওয়া যেত। ক্যাম্পাস ছাড়ার পরও সম্ভবত তিনিই একটানা এত বছর ধরে সংগঠনে সময় দিয়েছেন। জাকিরভাই, লিংকনভাইসহ আরও অনেকে বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখতে আসতেন অনিয়মিত। প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যদের আরও অনেকে কথা আমরা শুনতাম, তবে দেখা হয়নি। তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, ব্যস্ত অনেক। সেলিমভাইকে আমরা অনেকেই সামনাসামনি দেখিনি এখনো। তখন ইন্টারনেট বা টেলিযোগাযোগ এতো সুলভ ছিল না। একবার বাবুভাই এসেছিলেন। ২০০৭ সালের সমাবর্তনে বেশ কয়েকজন একসঙ্গে এসেছিলেন। তাঁরা কেউ কেউ সরকারের বড় কর্মকর্তা। এখন আমরাও ব্যস্ত থাকি এবং তাঁদের অবস্থাটা উপলব্ধি করি। একটা পর্যায়ে চাইলেও খুব বেশি সময় সংগঠনে দেওয়া যায় না।

বিভিন্ন উৎসবে আমাদের টানা কয়েকদিন অনুষ্ঠান থাকতো। তখন দিনে-রাতে কাজ করতে হতো। এমনও হয়েছে সারা রাত ক্যাম্পাসে রান থ্রু রিহার্সেল করে ভোরে মেসে ফিরে ঘুম দিতাম। সেই বিকেলেই আবার ফাইনাল শো। তার মধ্যেই কারও সকালে ক্লাস, কারও টার্ম টেস্ট, কেউ ফুল আনতে শহরে যাবে, কেউ পোশাক জোগাড় করবে, কেউ লাইট, কেউ মিউজিক, কেউ ব্রুশিয়ার, কেউ সুভ্যেনির, কেউ খাবার, কেউ টিকিট বিক্রয়, কেউ অতিথি অভ্যর্থনা, কেউ অনুষ্ঠান ঘোষণা, কেউ সবকিছুর সমন্বয় ইত্যাদি কাজ নিশ্চিত করবে। কীভাবে যে সময়মতো সব সম্পন্ন হতো ঠিকঠাক—তা আজও আমার কাছে এক বিস্ময়। সবকিছু সামলে মঞ্চে অভিনয়টাও এদেরই করতে হতো, বাইরের কেউ নয়। তবে বড় অনুষ্ঠানে আমাদের সহায়তায় বাড়তি কয়েকজন এসে হাজির হতো। তাঁরা দিকের সদস্য, কিন্তু ফ্লোরে নিয়মিত আসতে পারতো না বিভিন্ন কারণে। কিন্তু প্রোগ্রামের বাড়তি চাপের সময় ঠিকই এসে সহযোগিতা করতো।

জিয়াভাই, মহসিনভাই ভালো সংগঠক ছিলেন। স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের মতো নতুনদের খুব উৎসাহ-অনুপ্রেরণা দিতেন। শিমু-মহসিন জুটি তখন সারা ক্যাম্পাসে পরিচিত। তাঁদের দেখে আমাদেরও কারও কারও অব্যক্ত ইচ্ছে হতো প্রেম করার। তাহলে হয়তো ক্যাম্পাসে সময়টা অন্যরকম কাটতো। সে যাই হোক, সম্ভবত পরবর্তী সময়ে জাহিদ ব্যতীত আর কেউই এক্ষেত্রে সফল হয়নি। শিমু-মহসিন দুজনেই ভালো অভিনয় করতেন। শিমু আপুর আবৃত্তিও ছিল চমৎকার। কিন্তু দিকের প্রাণভোমরা ছিলেন রাজীবভাই। তিনি কথা কম কাজ বেশি নীতিতে বিশ্বাসী, সিনিয়র-জুনিয়র সকলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও আপনজন। নীরবে সব সাংগঠনিক ঝামেলা সামলে নিতেন। টাকাপয়সার যে কোনো সমস্যায় সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। আমরা ভাবতাম, তাঁর ভাণ্ডার অফুরন্ত! অভিনয়ে তাঁকে কম দেখা গেলেও সেটা খুব ভালো জানতেন। নির্দেশনা, আলোকসম্পাত, শব্দ সংযোজন, মঞ্চসজ্জা, পোশাক পরিকল্পনা, সংগীত, চরিত্র নির্ধারণ, লেখালেখি, সম্পাদনা, শিল্প নির্দেশনা, নকশা ইত্যাদি সব কাজে নিপুণ পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আফসোস, সেই সময়টায় তাঁকে আমরা যথাযথ সহযোগিতা করতে পারিনি। নইলে হয়তো আরও ভালো কিছু কাজ বেরোতে পারতো।

অভিনয় ও নির্দেশনায় সেরা ছিলেন মামুনভাই। তাঁর একনিষ্ঠ আত্মনিবেদন দেখে আমরাও নিজেদের সেরা কাজটা বের করে আনতে সচেষ্ট থাকতাম। তিনি ঢাকার একটা থিয়েটার গ্রুপে কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন। সেটা আমাদের জন্য এক বিশাল অনুপ্রেরণা ছিল। মাসুমভাইয়ের আওয়াজটা ছিল ভরাট। জনিভাই ছবি তুলতেন ভালো। রাজীব-মামুন-মাসুম-জনি সমসাময়িক। পড়াশোনায় মনোযোগ কম দেখা গেলেও তাঁদের জ্ঞানের ভাণ্ডার ছিল বিচিত্র সব বিষয়ে সমৃদ্ধ। রাত-বিরাতে ঘুরে বেড়াতেন, গল্প যেন শেষই হতো না। তাঁদের মুখস্ত ছিল তখনকার ক্যাম্পাসের সুন্দরী বালিকা ও শিক্ষিকাদের যাবতীয় পরিসংখ্যান। দোলনভাই-সৈকতভাইও সম্ভবত একই ব্যাচে ছিলেন। কিন্তু তাঁদের নিয়ে স্মৃতি কম।

সিনিয়র ছিলেন অরূপদা, কিন্তু আমরা তাঁকে সবসময় সেই মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করতাম। হাসি-ঠাট্টা করতাম অনেক। কিন্তু তিনি ছিলেন সত্যিকারের গুণী মানুষ। ছবি আঁকতেন, গীটার বাজাতেন, গ্রাফিক্স ডিজাইন করতেন। এরপর আমাদের ব্যাচ: তন্ময় সরকার কঠোর পরিশ্রমী ও দায়িত্বশীল। ভালো আড্ডাবাজ। তবে তাঁকে পাওয়া যেত কম। ব্যস্ততার তার অন্ত ছিল না। বিশাল বপু নিয়ে ফ্লোরে ও মঞ্চে দাপুটে উপস্থিতি আর দরাজ কণ্ঠ সহযোগে তার অভিনয় দেখে আমরা মুগ্ধ হতাম। পলাশ চক্রবর্তী তুখোড় অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী। গোলাম রসুল পাবেল ভালো সংগঠক ছিল, অভিনয়ে তার মনোযোগ ও সামগ্রিক প্রচেষ্টা দেখেছি সবসময়। মুজিব ছিল শুধুই সংগঠক, অভিনয়ে কোনো আগ্রহ তার ছিল না।

তারপরে এলো জাহিদ ও সাবরিনা এবং তারেক। জাহিদ অভিনেতা ও সংগঠক দুই ভূমিকায়ই অসাধারণ, এই দুই গুণের এমন সমন্বয় খুব কমই পাওয়া যেত। আর সাবরিনার গুণের কোনো শেষ নেই। সে ভালো গান করে। শিমু আপু সিলেট ছেড়ে চলে যাওয়ার পরে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সাবরিনা সেটা সার্থকভাবে পূরণ করে। অভিনয়ে নিবেদিতপ্রাণ, অন্য যেকোনো দায়িত্বেও। সাবরিনার শূন্যস্থান পরবর্তী সময়ে দিকে আর কোনো অভিনেত্রী পূরণ করতে পেরেছে কিনা আমার জানা নেই। তারেক খুব কৌতুকবাজ ছিল। অভিনয় ও সাংগঠনিক কাজে দক্ষ, তার সঙ্গ আমাদের খুব আনন্দ দিত। এ সময় ফয়েজ, আলমগীর, মন্টি দিদি—ওরাও সক্রিয় যদিও কিছুটা অনিয়মিত।
সমসাময়িক এত সব গুণী শিল্পীর ভিড়ে আমার তেমন কিছুই করার থাকতো না। তবু হাজির থাকতাম, শ্রোতা হিসেবে ভালো ছিলাম যেকোনো আড্ডায়। মিশে যেতে পারতাম অনেকটা আলুর মতোন। সব তরকারিতে দেওয়া যায়, তবে দিলেও চলে, না দিলেও স্বাদের তেমন হেরফের হয় না! এমন নির্গুণ হওয়া সত্ত্বেও সংগঠনের প্রায় সবাই আমাকে খুব ভালোবাসত। মঞ্চেও মাঝে মধ্যে জায়গা পেয়ে যেতাম। সংগঠক হিসেবে আমার অনেক ঘাটতি ছিল। তারপরও প্রাপ্তি অনেক, সুখস্মৃতিও। প্রকাশনার কাজগুলো আনন্দ নিয়েই করতাম। সেই অভিজ্ঞতা পরে অনেক কাজে লেগেছে।

ক্যাম্পাসে আমাদের সময় নিয়ে লেখার মতো আরও অনেক বিবরণ, অনেক ঘটনা আছে। প্রতিটি প্রযোজনা প্রতিটি প্রদর্শনী নিয়ে কত স্মৃতি! পরবর্তীতে মাসুদ, সাগর, মৃদুল, মাহমুদা, রিফাত, রাজীব, মানিক, তনু, মৌ, মাহমুদ, নয়ন….ওরা এবং আরও অনেকে এসেছে। ওদের কাজ সরাসরি দেখবার সৌভাগ্য আমার খুব কম হয়েছে। সেসবের মূল্যায়ন ও বিবরণ অন্য কেউ তুলে ধরবে নিশ্চয়ই। এখানে কারও নাম ও ভূমিকা বাদ পড়লে সেটা নিতান্তই অনিচ্ছাকৃত।তারপরও আমি দুঃখপ্রকাশ করি। নির্মোহ বিবরণ দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি, তবে এটা যে নির্ভুল ও চূড়ান্ত—তা নয়। তারপরও আমার কোনো মন্তব্যে কেউ আহত হয়ে থাকলে দুঃখিত।

আশিস আচার্য
দিকথিয়েটার।