স্মৃতির বাক্সটা একটু খুলি। তখন সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রেখেছি। যা দেখি তাতেই কৌতুহল। গ্রাম থেকে শহরে গিয়েছি, গায়ে তখনো কাদা-মাটির গন্ধ, দু-চোখে অবাক বিস্ময়। কতো জায়গা থেকে ছেলেমেয়েরা এসেছে! শুধু পড়াশোনা নয়, আরও কতো বিচিত্র সব কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত তারা। একদিন দেখি ‘ডি’ বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তায় ‘দিক নাট্য সপ্তাহ’ নামে একটা দোকানমতো খুলেছে। লাল জামা পরা একজন ছাত্রী নাটকের টিকিট বিক্রি করছেন। তাকে ঘিরে আরও কয়েকজন সিনিয়র বসে আড্ডা দিচ্ছেন। টিকিটের দাম অল্প। নিয়ে নিলাম একটা। হলুদ কাগজে কালো কালিতে লেখা, নাটকের নাম: ‘বিবিসাব’। তখনও আমার নাটক দেখা টেলিভিশন পর্যন্তই সীমিত ছিল। মঞ্চনাটক জিনিসটা কেমন হয় জানতে ইচ্ছে হলো। সেদিন সন্ধ্যায় মিনি অডিটোরিয়ামে গিয়ে ‘বিবিসাব’ দেখলাম। বিস্ময় জাগল এই দেখে যে খালি মঞ্চে একদল জীবন্ত মানুষ কী চমৎকার অভিনয় করে গেল। সেই লাল জামা পরা মেয়েটিই এখানে বিবিসাব! আর তাঁকে ঘিরে থাকা বাকিরাও মঞ্চে বিভিন্ন চরিত্রে। লাইট, মিউজিক, কাহিনি, সংলাপ—সব মিলিয়ে যেন ঘণ্টাখানেকের জন্য আরেক জগতে আমায় নিয়ে গেল! যবনিকাপাতের পরে দেখি তাঁরা আবার সাধারণ মানুষের মতোই নিচে নেমে ঘোরাফেরা করছেন, কথা বলছেন, হাত মেলাচ্ছেন। আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁদের কাছাকাছি যাই, কিছু জিজ্ঞেস করি। কিন্তু তা না করে বেরিয়ে আসি, যদিও সেই নাটকের রেশ রয়ে গিয়েছিল। মাথার ভেতরে ঘুরছিল কীভাবে এত সুন্দর করে নাটক বানায়, আবার সেটা নির্ভুল অভিনয়ের মাধ্যমে সরাসরি মঞ্চে প্রদর্শন করে দেখায়?
পরের দিনও ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখি দিকের স্টলে সেই নাটকের মানুষগুলোই বসে আছেন। সাহস করে কাছে গেলাম। তাঁরাই আমায় ডেকে আলাপ করলেন, সদস্য ফর্ম এগিয়ে দিলেন। নিয়মকানুন জানালেন, পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হতে হবে। একটু ভড়কে গেলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার কথা মনে পড়ল, নাটকের দলে ভর্তি হতে নিশ্চয়ই আরও কঠিন পরীক্ষা দিতে হয়। তবু মনে হলো, চেষ্টা করে দেখি কেমন হয়। আসলে তখন মঞ্চনাটক ও অভিনয় সম্পর্কে প্রত্যক্ষ ধারনা পাওয়ার ইচ্ছেটা বাড়ছিল।
তারপর নানাভাবে দিক-এর সঙ্গে জড়িয়েছি। তবে অভিনয় শেখার চেষ্টা করেও বেশিদূর এগোতে পারিনি। তারপরও সংগঠনের বিভিন্ন কাজে যুক্ত হয়ে আনন্দ পেতাম। বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার পর মনে হলো, অভিনয়টা বোধহয় কিছু কিছু শিখেছি।
আসলে ততদিনে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টেছে, নানা রকম অভিজ্ঞতাও হয়েছে। সাহিত্যের ক্লাসে যা যা পড়তাম, মঞ্চের সঙ্গে মেলানোর চেষ্টা করতাম। আর মঞ্চের চরিত্রের সঙ্গে জীবনের সামঞ্জস্য খুঁজতাম । Shakespeare-এর As You Like It নাটকের একটা সংলাপ আমায় চমকে দিয়েছিল:
“All the world’s a stage,
And all the men and women merely players;
They have their exits and entrances,
And one man in his time plays many parts,”
মানে গোটা পৃথিবীটাই এক সুবিশাল রঙ্গমঞ্চ, আর সব নারী-পুরুষ তাতে শুধুই অভিনয়শিল্পী। তাদের নিজ নিজ ‘প্রবেশ’ এবং ‘বাহির’ আছে। আবার একই মানুষ বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করে।
আজও মনে হয়, কথাগুলো যথার্থ। ঘরে-বাইরে সবখানে আমরা তো সবাই অভিনয় করে চলেছি। একই মানুষের কত রূপ: ছাত্র, টিউশনির মাস্টার, থিয়েটারকর্মী, কবিতাপাঠক, ঘোষক, সম্পাদক, চাকরিজীবী, সাংবাদকর্মী, অনুবাদক, দোভাষী, শান্তিরক্ষী, সেনা কর্মকর্তা, যাত্রী, পর্যটক ইত্যাদি কত না চরিত্র। সবই অস্থায়ী চরিত্র, কোনো একটাতে স্থির হতে পারিনি, এ যেন এক যাযাবর জীবনযাপন। আবার যখন বাড়িতে থাকি কখনো সন্তান, কখনো ভাই, কখনো স্বামী, কখনো বাবার চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। আজীবন এই অভিনয় করে যেতে হবে। ভালো অভিনয় না জানলেও মুক্তি নেই।
-আশিস আচার্য
দিক থিয়েটার।
অসাধারণ।
মুগ্ধতা রেখে গেলাম ❤