আকাশের তারা দেখার সবেচেয়ে প্রাকৃতিক পদ্ধতি কি জানেন?ভাবছেন তারা দেখার আবার পদ্ধতি কি?তারা তো খালি চোখেই দেখা যায়।আর যারা তারা নিয়ে গবেষণা করে,তারাতো দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে।
তারা দেখার প্রাকৃতিক নিয়ম আমি ও জানতাম না।
সবকিছু জানা যায় না,দেখতে হয়।
আমার সৌভাগ্য হয়েছে।
তারা দেখতে হবে,কোন এক শরতের রাতে -হাওরের মাঝখানে নৌকায় শুয়ে শুয়ে।তখন দেখতে পাবেন তারা দের সত্যিকারের দেশ।তাদের ও শাসন ব্যবস্থা আছে। সংসার আছে। আছে ছোটাছুটি
আর ও কতকিছু।তারাদের রাজপ্রাসাদ সত্যি কারের।
যখন শুকনো মৌসুমে যোগাযোগের মাধ্যম ছিল পা আর বর্ষায় নৌকা।তখন পথ পথিকে সৃষ্টি করত।শুকনো মৌসুমে পথ থাকত এলোমেলো আর বর্ষায় সোজা।
যে পথ দিয়ে নৌকা চলত,দেখতে অনেকটা মিঠামইনের
রাস্তার মত।যেন রাস্তা পানিতে ভাসছে।অথবা লম্বা সাদা মাছ পিঠ উচু করে আছে।এমন রাস্তা দিয়ে আপনি হাটবেন,সেলফি তুলবেন,এটা তো রীতিমতো স্বপ্ন।আর বাইক চালানো -সেতো দুঃস্বপ্ন।
স্বপ্ন ও সত্যি হয় আর দুঃস্বপ্ন তো মহা সত্যি।
এজন্য আপনাকে যেতে হবে কিশোরগঞ্জের ইটনা মিঠামইন-অস্টগ্রাম।
অসম্ভব ভ্রমণপিপাসু মানুষ কামরুল স্যার।ভার্সিটির বড় ভাই বলল চলেন সাজেক যাই।আমি বললাম সাজেক যাওয়ার মতো অর্থ ও সময় নেই তারচেয়ে বরং বাইকে মিঠামাইন যাই।সে বলল এই শুক্রবার যাই।আমি বললাম ওকে পাটনার রেডি করেন।বাবুল কে বললে রাজি হবে।আর ইকবালকে নেওয়া যাবে না।ও এক্সিডেন্ট করেছে।
তারপর ও মুহুর্তেই আমারা ছয় জন রাজি হয়ে গেলাম।
ট্যুর গাইড কামরুল স্যার।জিজ্ঞেস করলাম কোন রোডে যাবেন?সুনামগঞ্জের শাল্লা দিয়ে।আমি বললাম শাল্লা দিয়ে মিঠামইন যাওয়া যায় এমন তো শুনি নাই।বলল গুগল ম্যাপে দেখেছে।আমি বললাম কয়েকদিন আগে ফেইসবুক এ দেখলাম শাল্লার ভাঙা রাস্তা নিয়ে আন্দোলন করতে।কামরুল স্যার ও গুগল ম্যাপ কে বিশ্বাস করলাম। সন্দেহ রয়ে গেল।আমি বললাম চলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়া যাই।কিন্তু তিনি তার সুনামগঞ্জের বন্ধু কে ফোন দিলেন।তার দেখানো পথে আমাদের যাত্রা।
প্রথমে সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ শহরে প্রবেশের আগে মদনপুর থেকে দিরাই।দিরাই থেকে শ্যামারচর বাজার।ওখান থেকে ট্রলারে কিশোরগঞ্জের ইটনা।আমার কিন্তু সন্দেহ রয়েই গেল।বললাম বাইক যদি না নেওয়া য়ায় আমি যাব না।
ভোর চারটায় বন্ধু বাবুল ফোন দিয়ে ঘুম থেকে উঠালো।পরক্ষণেই কামরুল স্যারের কল।বললো বাবুলকে নিয়ে পাঁচটার মধ্যে মদিনা মার্কেট পয়েন্টে চলে আসেন।আমি আর বাবুল মদিনা মার্কেট গিয়ে দেখি কেউ নেই।ফোন দিলাম -তাদের আর দেরি সহ্য হচ্ছে না।তারা ভার্সিটি গেইট চলে গেছে।ভার্সিটি গেইট গেলাম।গিয়ে শুনি হুমায়ুন ভাই ও মাহি ভাই (ভার্সিটির ) যাচ্ছে না।তার মানে আমরা চার জন হয়ে গেলাম।কামরুল স্যার,ইমরাজ স্যার,বাবুল স্যার ও আমি(সহকর্মী).
মোহ -মায়া এই শব্দ গুলো ভয়ংকর রকমের খারাপ।আপানাকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে দিবে।আপনাকে মায়া ত্যাগ করতে হবে।সিলেট থেকে সুনামগঞ্জ-দিরাই -শ্যামারচর -হাওর এর সৌন্দর্য পুরোটাই মায়া।আপনি আটকা পরলে আর মিঠামইন যেতে পারবেন না।আমরাও মায়ায় পড়েছিলাম।তার প্রমাণ কিছু ক্যামেরা বন্দি করেছি।আবার দ্রুতই মায়া ত্যাগ করেছি।তার প্রমাণ আমরা মিঠামাইন গিয়েছি।
বাইক নৌকায় ওঠানোর আগ পর্যন্ত আমার সন্দেহ ছিল-
শেষ পর্যন্ত আমরা মিঠামাইন যেতে পারব তো।কিন্তু সব জল্পনা কল্পনা অবসান ঘটিয়ে আমারা নৌকায় উঠলাম।
শুরু হল গান। মূল শিল্পী ইমরাজ।স্বর্ণপদক প্রাপ্ত মঞ্চ অভিনেতা।চমৎকার গান গায়। আমরা ও তার সাথে গলা মিলালাম।গান শুনে মাঝি মামা তার ভাগের তালের পিঠা আমাদের খেতে দিল।সেতো পিঠা নয়, যেন পূর্ণিমার চাঁদ।
কামরুল স্যার বলল এই চাঁদের উপর আমি কামড় বসাতে পারবো না।আমরা তিন জনে খেলাম।তার ভাগের অংশ মাছে কে দিলাম।পরে অবশ্য পিঠা না খাওয়ার আসল কারন খুজে পেয়েছি।দিরাই হোটেলে পরোটা দুইটা বেশি খেয়েছে।খাবেই বা না কেন হাওরের হাসের ডিমের ওমলেট।
সাড়ে বারোটার দিকে আমারা ইটনার কাছাকাছি পৌঁছালাম।মাঝি মামা তখন অন্য তথ্য দিল -ইটনায় নেমে বাইকে মিঠামাইন কিংবা অষ্টগ্রাম যাওয়া যাবে না।মিঠামাইন গেলে আজকে আর শ্যামারচর ফেরা যাবে না।মাঝি মামাকে বললাম রাত যতই হোক আমরা মিঠামাইন যাব এবং বাসায় ও ফিরবো।মামা বলল হাওরে রাতে ডাকাতি হয়।আমরা মামা কে অতিরিক্ত টাকা অফার করে রাজি করালাম।কামরুল স্যার কে বললাম আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়েই আসা উচিত ছিল।আধঘণ্টা ট্রলার চলার পর স্থানীয় লোক মারফত জানতে পারলাম ইটনা দিয়েই মিঠামাইন যাওয়া যায়।প্রচণ্ড রাগ হল মাঝি মামার প্রতি।আমাদের ট্রলার ভিড়ল ইটনায়।মাঝখানে অতিরিক্ত এক ঘণ্টা বেশি সময় লাগল।
আমরা বাইক নিয়ে ঘুরলাম ইটনা-মিঠামইন- অষ্টগ্রাম।এর সৌন্দর্য্য বর্ণনাতীত।আমার পক্ষে তো অসম্ভব।আমরা অষ্টগ্রামের রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেলাম হাওরের মাছ দিয়ে।
হোটেলের খাবারের স্বাদ কামরুল স্যারের ভাষায় –
কোন এক লেখক বইমেলায় তার প্রথম বই নিজের পয়সায় পঞ্চাশ কপি প্রকাশ করার পর।বন্ধু বান্ধবী দের উপহার দিয়ে প্রথম মুদ্রণ শেষ। ২য় মুদ্রণ ২৫ কপি শেষ হলে তৃতীয় মুদ্রণ বাজারে দেখে বই কেনা বোকা পাঠকের মত আমাদের অবস্থা।
খাবার খেয়ে ইটনায় আসলাম।হাওরের জলে গা ভাসিয়ে,জলকেলি সাঙ্গ করে নৌকায় উঠলাম।বাড়ি ফেরার উদ্দেশ্যে।
ক্লান্তি আমাদের ক্ষমা করেছে, কামরুল স্যার ঘুমিয়ে পড়ছেন।ইমরাজ স্যার আবার গান ধরল।চারিদিকে এত পানি কিন্তু আমাদের খাবারের পানি নেই।গান থেমে গেল।সন্ধ্যার একটু আগে কামরুল স্যার ট্রলারের ছাদে আসলেন। এসেই দার্শনিকের মতো ভঙ্গিতে বললেন কেন ঘুম ভেঙেছে জানেন এই সুন্দর দৃশ্য দেখার জন্য।হাওরে কখনও সন্ধ্যা নামা দেখেছেন?
তারপর শুরু হল তার একের পর এক গল্প।
ট্রলারের ছাদে শুয়ে গল্প করছি আর তারা দেখছি।
দূরে মাহমুদ
২০২১০৯০৩
দিকথিয়েটার